
ব্যাপক বিতর্ক-সমালোচনা, সেন্সর-জট এবং ক্ষমতাসীন বিজেপির সহায়তায় এত প্রচারের পরও দর্শকের মনে দাগ কাটতে পারেনি মুসলিম-বিদ্বেষী সিনেমা ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’। উগ্র হিন্দুত্ববাদী বলিউড চলচ্চিত্র নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রীর প্রোপাগাণ্ডা চলচ্চিত্রটি মুক্তির পরই মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রথম দিনেই এটি বক্স অফিসে ভরাডুবির মুখে পড়ে। এরপর গেল তিন দিনেও সাড়া ফেলতে পারেনি মুসলিমদের খলনায়ক উপস্থাপন করে তৈরি করা চলচ্চিত্রটি।
হিন্দি চলচ্চিত্রের টিকিট বিক্রি
বক্স অফিস অনুযায়ী, ছবিটি প্রথম দিনে মাত্র ১.৭৫ কোটি আয় করেছে। বিবেক অগ্নিহোত্রীর আগের বিতর্কিত ছবি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ মুক্তির দিনে আয় করেছিল ৩.৫৫ কোটি। এটি একইসাথে মুক্তি পাওয়া অন্য ছবির ধারেকাছেও ভিড়তে পারেনি।
সমালোচকরা বলছেন, বিবেক অগ্নিহেত্রী বরাবর মুসলিম বিদ্বেষমূলক সিনেমা তৈরি করেন। ছবির বিষয়বস্তু রাজনৈতিকভাবে একপেশে এবং ইতিহাসকে নগ্নভাবে বিকৃতি করা হয়েছে। ফলে সাধারণ দর্শকের আগ্রহ কমেছে। ১৯৪৬-এর যে অপ্রিয় ঘটনাটি ঘটেছিল সেটিকে উস্কে দেওয়ায় এই সিনেমার উদ্দেশ্য।
হিন্দি চলচ্চিত্রের টিকিট বিক্রি
গত ৫ সেপ্টেম্বর টাইগার শ্রফ ও সঞ্জয় দত্তের ছবি ‘বাঘি ৪’ এবং বিবেক অগ্নিহোত্রীর ছবি ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ প্রেক্ষাগৃহে একইসাথে মুক্তি পায়। টাইগার শ্রফ এবং সঞ্জয় দত্ত অভিনীত ‘বাঘি ৪’ ছবিটি পরিচালনা করেছেন এ হর্ষ। সমালোচকদের কাছ থেকে এই ছবিটি প্রশংসা পেয়েছে। এই ছবিটি প্রথম দিনে ১২ কোটি টাকা আয় করেছিল। দ্বিতীয় দিনে এটা ৯.২৫ কোটি টাকা আয় করে। স্যাকনিষ্কের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে, ‘বাঘি ৪’ রবিবার তৃতীয় দিনে ৮.৫৯ কোটি টাকা আয় করেছে। এইভাবে, ভারতীয় বক্স অফিসে এখনও পর্যন্ত ছবিটির মোট কালেকশন ২৯.৮৪ কোটি টাকা হয়ে দাঁড়িয়েছে
অন্যদিকে, বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ ছবিতে মুসলিম বিদ্বেষী অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী, পল্লী জোশী, অনুপম খের, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, সৌরভ দাসকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে। আয়ের কথা বলতে গেলে, এটি ‘বাঘি ৪’-এর থেকে অনেক পিছিয়ে। ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ প্রথম দিনে ১.৭৫ কোটি টাকা, দ্বিতীয় দিনে, ২.১৫ কোটি এবং তৃতীয় দিনে ২.৫৪ কোটি টাকা আয় করেছে। ভারতীয় বক্স অফিসে এখনও পর্যন্ত ছবিটির মোট কালেকশন ৬.৪৪ কোটি টাকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেঙ্গল ফাইলস বই
বিতর্কিত বলিউড পরিচালক অগ্নিহোত্রীর নতুন ছবি ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ মুক্তি পাওয়ার আগেই দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক ও সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে। যদিও ছবিটিকে সব ধরনের সমর্থন দিচ্ছে ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি। মুসলিম-বিদ্বেষী দলটির দাবি, দেশভাগের সময় বাংলার হিন্দুদের ওপর চালানো নির্মম অত্যাচার ও গণহত্যার ইতিহাস এই ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ, ছবিটি সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়িয়ে রাজনৈতিক পরিবেশকে বিষিয়ে তুলতে চায়। বিশেষ করে আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ছবিটি মুক্তির সময়সূচী নিয়েও প্রশ্ন তুলছে তারা।
প্রথমে ছবিটির নাম ছিল ‘দিল্লি ফাইলস’। তবে পরে নাম পাল্টে রাখা হয় ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’, কারণ মূল কাহিনীর পটভূমি বাংলাকে ঘিরে। ছবিটিতে দাঙ্গার সময় হাজারো হিন্দুর প্রাণ রক্ষাকারী হিসেবে পরিচিত ‘গোপাল পাঁঠা’র ভূমিকায় আছেন অভিনেতা সৌরভ দাস।
তবে সৌরভ দাস সম্প্রতি জানিয়েছেন, তিনি আসলে দিল্লি ফাইলস-এর জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন এবং কেবল নিজের অংশের চিত্রনাট্য জানতেন। পুরো কাহিনী নিয়ে তার কোনো ধারণাই ছিল না।
ছবির অন্যতম আলোচিত চরিত্র গোপাল পাঁঠাকে মুসলিম বিদ্বেষী কসাই হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
গোপাল পাঁঠা ওরফে গোপাল মুখোপাধ্যায়ের বর্তমান প্রজন্মের উত্তরাধিকারীরা অভিযোগ করেছেন, ছবিটিতে তাকে যেভাবে একজন ‘মুসলিম-বিদ্বেষী কসাই’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, সেটা কোনো মতেই মানা যায় না। গোপাল পাঁঠার পৌত্র শান্তনু মুখার্জি দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, তার পিতামহ দাঙ্গার সময় বহু মুসলিমেরও প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এবং বহু মুসলিমের সঙ্গেই তার দারুণ সম্পর্ক ছিল।
তার পরিবার এই অভিযোগ তুলে এবার কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। তারা বলেছেন, গোপাল পাঁঠার যে চরিত্র তুলে ধরেছেন পরিচালক বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রী, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং এক ভয়ঙ্কর প্রোপাগান্ডামূলক। দাবি জানানো হয়েছে শুধুমাত্র এই চলচ্চিত্র নয় সব ধরনের জায়গা ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে যেন মুছে ফেলা হয় ফিল্মের গোপাল পাঁঠা চরিত্রের অংশটি।
হিন্দি চলচ্চিত্রের টিকিট বিক্রি
আসলে অগ্নিহোত্রীর চলচ্চিত্রে সরকারি সহায়তা নতুন নয়। তার আগের ছবি দ্য কাশ্মীর ফাইলস প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি দেশবাসীকে ছবিটি দেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। যদিও ওই ছবিটি ছিল ‘ইসলামোফোবিক’ ও ‘প্রোপাগান্ডামূলক’। তারপরও বিজেপি-শাসিত প্রায় সব রাজ্যে ছবিটি করমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “পশ্চিমবঙ্গে এই প্রোপাগান্ডা ফিল্ম চলতে দেওয়া হবে না। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর চেষ্টা রাজ্য সরকার কিছুতেই মেনে নেবে না।”
হিন্দি চলচ্চিত্রের টিকিট বিক্রি
তিনি আরও বলেন, “বেঙ্গল ফাইলস বানানোর আগে গুজরাট দাঙ্গার ধর্ষিতা বিলকিস বানু নিয়ে গুজরাট ফাইলস কিংবা উত্তরপ্রদেশের হাতরাস-উন্নাওয়ের নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে ইউপি ফাইলস বানান, তারপর না হয় বাংলায় ঢোকার চেষ্টা করুন।
এছাড়া অগ্নিহোত্রীর বিরুদ্ধে আগেও ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। কখনও কংগ্রেসকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দল হিসেবে দাবি করেছেন। কখনও রাজনৈতিক নেতা কানহাইয়া কুমারের ধর্মান্তর নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য শেয়ার করেছেন। পরে এসব পোস্ট তিনি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন।
ইতিহাস বিকৃতি করে দেওয়া হয়েছে যে উস্কানি
অগ্নিহেত্রী গত প্রায় মাসখানেক ধরে তার টুইটার ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে ঘটে যাওয়া নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে একের পর এক পোস্ট করে চলেছেন। এর কোনওটায় তিনি লিখেছেন : ‘লক্ষ্মীপুজোর রাতে হিন্দু গণহত্যা সংঘটিত হয় গোলাম সারওয়ার ও তার ভাই ছোট মিয়ার ষড়যন্ত্রে’।
কোনওটায় আবার জানাচ্ছেন, ‘গোলাম সরকারের হাড় হিম করা ফতোয়া : সুচেতা কৃপালনীকে ধর্ষণ করলেই মিলবে ‘গাজী’ খেতাব!’
প্রসঙ্গত, সুচেতা কৃপালনী ছিলেন মোহনদাস গান্ধীর অনুগামী তরুণ কংগ্রেস নেত্রী, যিনি দাঙ্গা ঠেকানোর মিশন নিয়ে তখন নোয়াখালীতেই।
অন্যদিকে, গোলাম সারোয়ার হুসেইনি তখন ছিলেন নোয়াখালীর শ্যামপুর দায়রা শরীফের গদ্দিনশীর পীর এবং নোয়াখালি কৃষক সমিতির অত্যন্ত প্রভাবশালী মুসলিম নেতা। বিবেক অগ্নিহোত্রী আর একটি পোস্টে লিখেছেন : ‘নোয়াখালীতে কংগ্রেস নেতার বাড়িতে হামলা করে তার ছেলেকে খুন, জ্বালিয়ে দেওয়া হলো দলের অফিস’ এবং এরকম আরও অজস্র।
কিন্তু এত পুরনো একটি ঘটনা নিয়ে আচমকা পরিচালকের এই আগ্রহের কারণ কী?
বিস্ফোরক মন্তব্য করে ভারতীয় সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, বিবেক অগ্নিহেত্রীর সিনেমা দ্য বেঙ্গল ফাইলস আসলে একটি মুসলিম বিদ্বেষী সিনেমা। ১৯৪৬-এর যে অপ্রিয় ঘটনাটি ঘটেছিল সেটিকে উস্কে দেওয়াই এই সিনেমার উদ্দেশ্য। তিনি বরাবর মুসলিম বিদ্বেষমূলক সিনেমা তৈরি করেন। বিবেক অগ্নিহেত্রী অত্যন্ত খারাপ একজন পরিচালক এবং তাকে ঘিরে যে আলোচনা হচ্ছে, আসলে তিনি সেই মনোযোগের যোগ্য নন। তিনি তার সিনেমায় মুসলমানদের সবসময় খলনায়ক বানাতে চান এবং বিজেপিকে খুশি করে পরবর্তী সিনেমার জন্য টাকা নিতে চান। তিনি যে যে রাজ্যে সিনেমা তৈরি করেন, সেই সেই রাজ্যে বিজেপি হারে—এমনই